আর্য অধিক্রম তত্ত্ব সম্পর্কে স্টাডি নোটস

রাহুল সাংকৃত্যায়ন পাঠচক্রের স্টাডি নোটস

হরপ্পা সভ্যতা ছিল তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের অন্তর্গত। হরপ্পা পূর্ববর্তী মেহরগঢ় সভ্যতা ছিল নব্যপ্রস্তর বা নিওলিথিক যুগের শেষ পর্যায়ের অন্তর্গত। মেহরগঢ় সভ্যতা সম্পর্কে তথ্য খুবই সীমিত। মেহরগঢ় সভ্যতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব এবং হরপ্পার লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ার ফলে হরপ্পা সভ্যতার সময়কালে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা খুবই দুরূহ। সেই কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা শুরু হয় বেদের যুগ থেকে।

হরপ্পা সভ্যতার সময়ে red and blackware pottery, ১২০০-৬০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে painted grayware (pgw) pottery এবং ৭০০-২০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে northern blackware pottery দেখা যায়। হরপ্পার খনন কার্য থেকে যা তথ্য পাওয়া যায় তাতে ‘রাষ্ট্রের মতন কিছু একটা’-র ধারণা আসে কারণ বিভিন্ন খনন এলাকা থেকে প্রায় একই ধরণের বাটখারা বা মাপজোপের প্রক্রিয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সিন্ধু নদীর দুই পাশের পলির উপর বীজ ছড়িয়ে কৃষি কাজ এবং নদীর উপর বাঁধ তৈরি করতে পারদর্শী ছিল হরপ্পা সভ্যতা। এর ফলে হওয়া অতিরিক্ত উৎপাদন রপ্তানি করা হত। হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ হিসেবে মরটিমার হুইলারের ‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ পাওয়া যায় যা অনেকেই মানতে চান না। ঘগগর হাকরা নদীর শুকিয়ে যাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং জলবায়ু পরিবর্তন হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ হিসেবে অনেকেই দেখান। বলা হয় যে এই সভ্যতা পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়নি বরং তার অধিবাসীরা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়। ঘগগর হাকরা নদীকে অনেক সময়ে বেদে উল্লিখিত সরস্বতী নদী হিসেবে ধরা হয়। ‘বহিরাগত’ আর্য তত্ত্ব অনুযায়ী সরস্বতী আর্যদের দ্বারা চিহ্নিত কোনও ইরানীয় নদীও হতে পারে। বর্তমানে হরিয়ানার রাখিগোর্হী অঞ্চলে হরপ্পার সমসাময়িক কঙ্কাল পাওয়া গেছে।

আর্যরা কোনও জাতি নয়, ছিল ভাষা গোষ্ঠী। আর্য সভ্যতা নগর সভ্যতা নয়, ছিল গ্রাম গোষ্ঠী ভিত্তিক সভ্যতা। ঋগ্বেদ যতদিনে রচনা শুরু হয়েছে ততদিনে বেশকিছু আর্য গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই ভারতে অনুপ্রবেশ করে ফেলেছে। ঋগ্বেদের রচয়িতারা সাধারণ অনুপ্রবেশ করেনি বরং ভয়ঙ্কর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তাদের আফগানিস্তান ও ইরানের সীমানা থেকে যমুনা তীরে পৌঁছতে হয়েছে। উল্লেখ্য, ব্রহ্ম সূত্রে আফঘানিস্তান থেকে যমুনা তীর পর্যন্ত অঞ্চলকে আর্যাবর্ত বা দেবভূমি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরস্বতী-দৃশদ্ধতী অববাহিকা অঞ্চল আর্য সভ্যতার প্রাথমিক স্থল। ঋগ্বেদে যে সব নদীর কথা পাওয়া যায় তা মূলত বর্তমান দিল্লী, হরিয়ানা ও পাঞ্জাব অঞ্চলে অবস্থিত। অর্থাৎ বর্তমান ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বে আদি বেদের যুগের সভ্যতার ব্যাপ্তি। বাণিজ্য খুবই সীমিত। ঋগ্বেদের বিশদ অংশ জুড়ে শ্রেণী বিভক্তিকরণের ধারণা লক্ষ্য করা যায় না। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ‘পুরুষ সুক্ত’-এ বর্ণাশ্রমের আলোচনা দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু অন্যত্র কোথাও উচ্চ-নীচ ভেদাভেদের উল্লেখ নেই। ফলে হয়তো এই অংশটি পরে যুক্ত করা হয়েছে কারণ বর্ণ ব্যবস্থা পরবর্তী বৈদিক যুগের বৈশিষ্ট্য। তাই বলা হয়, ঋগ্বেদের প্রথম এবং দশম মণ্ডল নয়া সংযোজন; চতুর্থ বা অঙ্গিরা মণ্ডল সবচেয়ে পুরনো অংশ যেখানে কেবল যুদ্ধ কাহিনী বর্ণিত আছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের সময়কালে মূলত পশুচারণভিত্তিক সমাজ ছিল আর্যদের। আর্যরা শুরুতে ছিল পূর/নগর প্রতিষ্ঠা ও উৎপাদন সংক্রান্ত কার্যকলাপের বিরোধী। পরবর্তীতে কৃষিকার্যে প্রবেশের সময়ে লাঙলের ব্যবহার দেখা যায় না, বাঁধ বানিয়ে সেচের ব্যবস্থার প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ঋগ্বেদে ‘অয়স’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে যা কোনও ধাতু (সোনা বা তামা বা লোহা) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই শব্দের ব্যবহারে অনুমান করা যায় যে আর্যরা সেই সময়ে যাযাবর জীবনযাত্রা থেকে কৃষিকার্যে আস্তে আস্তে পদার্পণ করছিল। শুরুতে এই কৃষি উৎপাদন ছিল অনুন্নত এবং অনিশ্চিত। আর্যরা কৃষি কাজ জানত না। তারা কৃষি কাজ শিখেছিল বিজিত সভ্যতার থেকে। সমাজে উদ্বৃত্ত ছিল না (ফলে অন্নকে ব্রহ্ম হিসেবে দেখা হয়েছে), তাই শ্রেণীও ছিল না। আর্যদের রাষ্ট্র ছিল না কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠন ছিল (শ্রেণী বিভক্তিকরণ ও উদ্বৃত্ত রাজার কাছে যাওয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দ্যোতক)। ইউরোপীয় সমাজবিদ্যার ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্র না থাকলে রাজনৈতিক সংগঠন থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপটের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ পৃথক। আর্যদের মধ্যে শ্রেণী না থাকলেও সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে সামাজিক উদ্বৃত্ত ও শ্রেণী বিভক্তিকরণ ছিল। সিন্ধু সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার সাথে বাণিজ্য করত। আর্যরা এই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস করে ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। তাই সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র না থাকলেও আর্যদের রাজনৈতিক সংগঠন ছিল (সভা ও সমিতি)। অস্ট্রেলিয়ান পুরাতত্ত্ববিদ গর্ডন চাইল্ডের মতে প্রস্তর যুগে পাথর পালিশ করতে বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহার মানুষের জানা ছিল এবং নব্য প্রস্তর যুগে বিভিন্ন ধরণের পাথরের পৃথক পৃথক ব্যবহার মানুষের জানা ছিল। এর ফলে পাথর আদান প্রদানের জন্য সীমিত অর্থে আন্তর্জাতিক বাজারেরও অস্তিত্ব ছিল। নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আর্যরা ভারত ভূখণ্ডের তাম্র যুগে পদার্পণ করে বিস্ফোরক রাসায়নিক ব্যবহার করে সিন্ধু সভ্যতার বিনাশ করে মানব সভ্যতার পশ্চাদপসরণ ঘটায়, যার ফলে এখানে লোহা আবিষ্কার অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় বিলম্বিত হয়। ঋগ্বেদে একাধিকবার বজ্রের উল্লেখ রয়েছে। বজ্রের জন্যই আর্যদের ‘জয়’ লাভ। বজ্র বলতে এখানে বিস্ফোরক বোঝানো হয়েছে। ৮০০ খৃষ্ট পুর্বাব্দে লোহা আবিষ্কারের ফলে লাঙল তৈরি হল এবং জমির কর্ষণের ফলে কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতি দেখা গেল।

আদি বৈদিক যুগে আর্যরা ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে লুট, লুণ্ঠন ও বাঁধ ধ্বংস করার মাধ্যমে। আর্যদের মধ্যেকার নেতৃত্ব (পরবর্তীতে রাজন্যবর্গ বা রাজন্য নৈকট্য বর্গ) অর্থাৎ পরবর্তী বেদের যুগের শেষ অংশে ‘ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়’রা (শ্বেতাঙ্গ) নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করলেও বৈশ্যদের কিছু মাত্রায় ও শুদ্রদের থেকে পূর্ণমাত্রায় দূরত্ব বজায় রেখেছিল। এই রাজন্য বর্গের মধ্যে উৎপাদনমূলক শ্রমকে ঘৃণা করার আদর্শ বিদ্যমান ছিল। ১০০০-৫০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দ ‘পরবর্তী বেদের যুগ’। এই সময়ে সামবেদ, যজুরবেদ, অথর্ববেদ, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ রচিত হয়। উপনিষদে প্রথম রাষ্ট্রের ধারণা লক্ষ্য করা যায়। এই পরবর্তী বেদের যুগে সরল রাষ্ট্রের উৎপত্তি লক্ষ্য করা যায়। এর আগে ছিল কেবল সভা-সমিতি।

আর্যদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম স্তরের সমকালীন সৃষ্টি বৃহৎ আরণ্যক উপনিষদের ‘যাজ্ঞবল্ক্য-জনক সংবাদ’ অধ্যায়ে দেখা যায় যে সেই সময়ে ব্রাহ্মণের তুলনায় ক্ষত্রিয়দের সামাজিক আধিপত্য বেশি ছিল এবং বৈশ্য-শুদ্র বিভাজন অস্পষ্ট ছিল। এখানে বর্তমান হরিয়ানায় স্থিত তৎকালীন কুরু রাজ্য ও জনক রাজার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। আর্যদের প্রথম রাষ্ট্র হল কুরু রাষ্ট্র। কুরু রাষ্ট্র পরবর্তী বেদের যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়। কুরু রাজ্যের কথার অধর্ববেদে উল্লেখ পাওয়া যায়। জনক রাজার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে উপনিষদে। ‘যাজ্ঞবল্ক্য জনক সংবাদ’-এ যাজ্ঞবল্ক্য বেদান্ত দর্শন অর্থাৎ ব্রহ্ম জ্ঞানের অধিকারী এবং ব্রাহ্মণদের প্রতীক। আর জনক রাজন্যবর্গের প্রতীক।

ঋগ্বেদে ‘দেব’-রা সাধারণ মানুষের নেতা কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ ক্ষমতা ছিল না। পরবর্তী বেদের যুগে রাজারাই ‘দেব’-এর প্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের সাথে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করছে ব্রাহ্মণরা। প্রজাকে শাসন করতে রাজার প্রয়োজন ঐশ্বরিক ক্ষমতার যা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করছে ব্রাহ্মণকূল। বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে অরণ্য নিধনের জন্য প্রথমে আগুন ব্যবহৃত হত। তাই ঋগ্বেদে অগ্নিকে বিশেষ গুরত্ব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী বৈদিক যুগে লোহা আবিষ্কারের ফলে এই কাজ লোহার অস্ত্র দিয়েই সম্পন্ন হত। লোহার ফলা যুক্ত লাঙল উত্তর প্রদেশের জাখেরা অঞ্চলের খনন এলাকায় পাওয়া গেছে যা চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের যুগের অর্থাৎ লৌহ যুগের অন্তর্গত। ঋগ্বেদের সমকালীন রাজারা ছিল গোষ্ঠীপতি এবং রাজস্ব আদায়ের অধিকারী তারা ছিল না। পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজারা কৃষি উদ্বৃত্ত আদায়ের জন্য লোক নিযুক্ত করত। এই সময় থেকে রাজা ও বৈশ্যদের মধ্যে ভক্ষক ও খাদ্যের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ঋগ্বেদে ব্রাহ্মণ কথার অর্থ হল আর্য জাতি। পরবর্তীতে এর ব্যবহার বর্ণাশ্রমের সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায়। বৈশ্য শব্দটি এসেছে ‘বিশ’ থেকে যার অর্থ ‘জনগণ’। তারা প্রথমে কৃষি কাজ ও বস্ত্র বয়নের সাথে যুক্ত ছিল। শূদ্ররা প্রথমে রাজন্যবর্গের ফাইফরমাশ খাটত এবং পরবর্তীতে সরাসরি উৎপাদনের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। যজ্ঞানুষ্ঠানে শূদ্রদের আসা নিষিদ্ধ ছিল। ঐতিরীয় ব্রাহ্মণে শূদ্রদের সামাজিক অবস্থার অবনতি ও আর্যদের কায়িক শ্রমের প্রতি তাচ্ছিল্য লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষার্ধে উদ্বৃত্ত ও ব্যবসায়িক লেনদেন বৃদ্ধির সাথে সাথে বৈশ্যরা কৃষিকাজ থেকে ব্যবসায় মনোনিবেশ করে। তারা বিপুল অর্থের মালিক হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ছিল না। তাদের থেকে শূদ্র ও অনার্য (অন্তজ)-রা একটি পৃথক সংযুক্তি হিসেবে সমাজে স্থান পায় যাদের নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব ছিল।

পরবর্তী বেদের যুগে আর্যদের পশ্চিম অভিমুখে বিস্তার লক্ষণীয়। অর্থাৎ ভৌগোলিক সীমার ব্যাপ্তি ঘটছে। কৃষি কাজ শুরু হচ্ছে। দূর বাণিজ্য শুরু হচ্ছে। লিপির স্ট্যান্ডারডাইজেশান বা প্রমিতকরণ হচ্ছে। জমির উপর জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে, সম্পন্ন কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে, সমবায় তৈরি হচ্ছে, কারিগর এবং ব্যবহার্য যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়ছে। প্রায় ২৮ ধরণের কারিগরের কথা উঠে আসছে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন উপজাতিরা কৃষিকার্যে প্রবেশ করছে, সম্পদের বৃদ্ধি শ্রেণী বিভক্তিকরণ ত্বরান্বিত করছে, জনপদের সৃষ্টি হচ্ছে। পরবর্তীতে উত্তর ও পশ্চিম ভারত জুড়ে ষোড়শ মহাজনপদ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে… মহাজনপদগুলিতে জটিল প্রশাসন লক্ষ্য করা যায় না। পরবর্তী বৈদিক যুগের প্রথমদিকে ‘ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়’ এবং ‘বৈশ্য ও শূদ্রের’ দুটি সংযুক্তির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। ‘ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা’ ছিল শাসক এবং ‘বৈশ্য ও শূদ্ররা’ ছিল প্রজা। এই সময়ই আর্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক স্তর। প্রথম জটিল প্রশাসনিক ব্যবস্থা দেখা যায় মগধে হর্যঙ্ক বংশের বিম্বিসারের আমলে। তার আমলে কাশী, কোশল, বৃজি ও মগধের মধ্যে কলহ ও যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি হয়। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক এই বিম্বিসার ছিল কপিলাবস্তু কেন্দ্রিক গণরাজ্যের প্রধান আর তার সমসাময়িক ছিল কোশলরাজ প্রসেনজিত। প্রসেনজিতের সময় থেকেই রাজতন্ত্রের উন্মেষ। বিম্বিসারকে হত্যা করে তার পুত্র অজাতশত্রু সিংহাসনে বসে। রাজধানী দেবগিরি। শুরু হয় মগধের সীমানা বিস্তার। তারই আমলে আধুনিক অর্থে প্রথম দুর্গ প্রতিষ্ঠিত হয় পাটালিগ্রামে যা পরবর্তীতে পাটলিপুত্র নামে পরিচিত হয়। ঘটনাক্রম অনেকটা এইরকম: হর্যঙ্ক বংশের রাজত্বকালে সীমানা বিস্তার শুরু হয়, নন্দ বংশের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের ধারণা প্রস্ফুটিত হয় এবং মৌর্যদের শাসনকালে বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিম্বিসার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তার পুত্র অজাতশত্রু প্রথমদিকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিরূপ হলেও পরবর্তীকালে সহিষ্ণু হয়ে ওঠে। 

বুদ্ধের সময়কালে তার ধর্ম বৈশ্য-শূদ্রের বৌদ্ধিক হাতিয়ার হিসেবে ব্রাহ্মন-ক্ষত্রিয়ের বেদান্ত দর্শনের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রাম চালানোর জন্য কাজ করেছিল। প্রাচীন যুগে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যেকার যুদ্ধের মাধ্যমে শূদ্রদের রাজত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার মধ্যে নন্দ বংশ ও মৌর্য বংশ অন্যতম। এই শূদ্র রাজত্ব শেষ হচ্ছে পুষ্যামিত্র সুঙ্গের রাজত্ব স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। পুষ্যামিত্র সুঙ্গের সময় থেকে ব্রাহ্মণদের সামাজিক আধিপত্য বৃদ্ধি পেতে থাকে, ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বৈশ্য-শুদ্র বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আম্বেদকর এই সময়কে মনুবাদী প্রতিবিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। পুষ্যামিত্রের রাজপুরোহিত ছিল সুমতি ভার্গব বা মনু যে মনুস্মৃতির রচয়িতা। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক রোধ করতে বিভিন্ন বিভেদমূলক নিয়ম আনা হল মনুস্মৃতিতে। মনুস্মৃতি রচনার সময়ে ব্রাহ্মণ সরাসরি রাজা হওয়ার অধিকারী হয়ে উঠল। ৩০০ থেকে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ব্রাহ্মণদের নিঃশুল্ক জমিদানের অগ্রহর ব্যবস্থা কায়েম হল। এইভাবে মনুবাদের প্রয়োগের মাধ্যমে ব্রাহ্মণদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত হল। উল্লেখ্য, বাংলায় প্রথমদিকে সরাসরি চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা ছিল না। এখানে কায়স্থদের উপস্থিতি ছিল। কায়স্থ কথার অর্থ হল যারা কায়ায় স্থিত। ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যে তারা বায়স বা কাকের মত গলা হিসেবে বর্ণিত! বাংলায় তন্ত্র সাধনার চল ছিল যার মধ্যে ‘বামা ভূত্বা যজেৎ পরম’-এর প্রচলন ছিল অর্থাৎ ‘নারী হয়ে ওঠাই পরম সাধনা’। ‘তন্ত্র’ শব্দের অর্থ ব্যবস্থা, ফলে তন্ত্র বলতে শুরুতে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সেক্টকে বোঝানো হয়েছে; আধুনিক তন্ত্র সাহিত্য এর অনুরূপ নয়। 

প্রথমে জ্ঞান মৌখিক ছিল। অর্থাৎ আধুনিক অর্থে তৎকালীন জ্ঞানী নিরক্ষর হতেই পারত। বেদব্যাস এবং গণেশের মহাভারত রচনার কাহিনীকে এভাবে দেখা যেতে পারে: ব্যাসদেব জ্ঞানী কিন্তু নীরক্ষর তাই লেখার জন্য তার গণেশকে দরকার, অর্থাৎ ব্যাসদেব ও গণেশ এখানে ভিন্ন দক্ষতার প্রতীক। ৩২৭-৩২১ খৃষ্ট পূর্বাব্দ অর্থাৎ অ্যালেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় থেকে আধুনিক ঐতিহাসিক রচনার ন্যায় তথ্য পাওয়া শুরু হল। মেগাসথেনিসের মত গ্রীক ইতিহাসবিদদের ইতিহাস লেখার প্যাটার্ন আর্যদের মধ্যে দেখা যায় না। একটি মতানুসারে আর্যদের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রূপকের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন যুগে ইতিহাস লেখার পদ্ধতি ছিল রূপকাশ্রয়ী; ইউরোপীয় ইতিহাস রচনার পদ্ধতি থেকে স্বভাবতই পৃথক। দীর্ঘ সময় ধরে শ্রুতি হিসেবে বেদের প্রসারণের ফলে এই রূপকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আবার অন্য মতানুসারে নিজেদের ‘লুট-লুণ্ঠন’-কে ন্যায্যতা দিতেই রূপকের ব্যবহার শুরু হয়। এই রূপকের অর্থ বোঝা দরকার। তাই বেদের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। বেদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রাহুল সাংকৃত্যায়ন ও শ্রী অনির্বাণের বিপরীতমুখী ধারণা রয়েছে। শ্রী অনির্বাণ এবং মধুসূদন ওঝার বক্তব্য অনুযায়ী বেদ আসলে প্রকৃতির ব্যাখ্যা অর্থাৎ সামাজিক ইতিহাসের বদলে তা আদতে শুভ-অশুভের সংঘাত বা প্রকৃতির বর্ণনার মাধ্যমে মানসিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। উদাহরণস্বরূপঃ মেঘ ও সূর্যের দ্বন্দ্ব ‘ইন্দ্র’ এবং ‘কৃষ’-এর মধ্যেকার যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে প্রস্ফুটিত। ফলে এই যুদ্ধ কাহিনীকে আরোপিত অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে কিন্তু আদতে তা অনেক বেশি সোজাসাপ্টা। সোজাসাপ্টা যুদ্ধ কাহিনী রূপকের মাঝে মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ঋগ্বেদে। ঋগ্বেদের দশম মন্ডলে দশ রাজার যুদ্ধের কথা বলা আছে। আফঘানিস্তানের সিস্তান এলাকার অমরাবতী বা হেলমন্ড নদীর তীর থেকে ২০০ বছরের সময়সীমায় আর্যদের ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠী পাঞ্জাব এলাকার যমুনা তীরে দশ রাজার যুদ্ধের শেষে পদার্পণ করে। ২০০ বছরের সময়কালে তিন পুরুষ ধরে (বধ্রিয়াশ্ব -> দিবদাস -> সুদাস) আর্যদের ভারত গোষ্ঠীর লড়াই ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর পারস্পরিক ঐক্য স্থাপনের মাধ্যমে কুরু রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে ঋগ্বেদে দশ রাজার যুদ্ধের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে। ঋগ্বেদের দশ রাজার যুদ্ধের দুই পক্ষেই আর্য ও অনার্যরা ছিল (মতান্তরে এই যুদ্ধ আদতে আর্যদের কিছু গোষ্ঠীর সাথে অন্যান্য গোষ্ঠীর লড়াই)। সিস্তান এলাকায় ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠীর দিবদাসের নেতৃত্বে সেনাপতি ইন্দ্র কৃষ গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ শুরু করে। আর যমুনা তীরে এসে ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠীর সুদাসের নেতৃত্বে সেনাপতি ইন্দ্র দশ রাজার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই দুই অঞ্চলের যুদ্ধের মধ্যেকার ২০০ বছরের ব্যবধান এটাই বোঝায় যে ওই দুই সেনাপতি ইন্দ্র একই ব্যাক্তি নন। ফলে, এটা স্পষ্ট যে ব্যাক্তির নাম কালক্রমে পদে রূপান্তরিত হতে পারে এবং এই বিষয় সংক্রান্ত দ্বিধাবিভক্তি জন্ম দেয় অমরত্বের ধারণার।

ঋগ্বেদ রচনার আগে থেকেই বিভিন্ন আর্য গোষ্ঠী ভারতে এসেছে। ঋগ্বেদের সময়কালে ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠীর দ্বারা আঞ্চলিক কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বিনাশ করে ভারত ভূখণ্ডে পদার্পণকে ‘জয়’ অ্যাখ্যানের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। এই বিভিন্ন বর্ণিত কাহিনীগুলির মূল অংশ বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার প্রতিফলন। ‘জয়’ রচিত হওয়ার পরে ঋগ্বেদ পূর্ণরূপে রচিত হয়েছে। জয় হল দশ রাজার যুদ্ধের কাহিনী। ঋগ্বেদ হল জয় এবং বিভিন্ন রূপক ও দাশর্নিক সিদ্ধান্তের সংকলন যা শ্রুতির মাধ্যমে বেদব্যাস কর্তৃক প্রসারিত। ঋগ্বেদ হল জয় কিন্তু পূর্ণরূপে জয়ের কাহিনী নয়। জয়ের কাহিনীকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত করা হয়েছে ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠীর আঞ্চলিক কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বিনাশ সাধনের কাহিনীকে ঢেকে দেওয়ার জন্য। ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠীর পূর্বতন আর্য গোষ্ঠীদের অনার্যদের সাথে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। তাই বলা হয় যে এই আর্য গোষ্ঠীদের ভারতে ‘আগমন’ ঘটে কিন্তু ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠী বিদ্যমান সকল সভ্যতার ধ্বংস সাধন করেছিল বলে তাদের ভারত ‘আক্রমণ’-কারী বলা হয়ে থাকে। হরপ্পা সভ্যতার নিজস্ব লিপি ছিল কিন্তু আর্যদের কোনও লেখ্য লিপি ছিল না। তাছাড়া ঋগ্বেদে হারিয়োপিয়ার উল্লেখ আছে যাকে হরপ্পা হিসেবে অনেক সময়ে ধরে নেওয়া হয়। হরপ্পা সভ্যতার তুলনায় উন্নত চাষাবাদের পদ্ধতি না জানা থাকায় এই আর্যদের সংস্কৃতিতে যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতাদের সন্তুষ্ট করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে এটা বলা হয় যে ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠীর আর্যরা হরপ্পা সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে।

ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠীর নেতা সুদাস বিশ্যামিত্রকে বহিষ্কার করে বশিষ্ঠকে রাজপুরোহিতের (বুদ্ধিজীবী কর্মকর্তা) পদে অধিষ্ঠিত করে। বিশ্যামিত্র তখন কিছু অনার্য এবং আর্য গোষ্ঠী অর্থাৎ দশ রাজার পক্ষাবলম্বন করেন। এই গোষ্ঠীগুলির কারুর কারুর প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রও ছিল যাদের আধুনিক প্রজাতন্ত্রের সাথে পার্থক্য মূলত জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে। ফলে, জয়-এর অ্যাখ্যানে মূল লড়াই আর্য বনাম অনার্য যদিও উভয়দিকেই নিজ নিজ স্বার্থে উল্টোদিকের কিছু গোষ্ঠীর উপস্থিতি ছিল। জয়-এর অ্যাখ্যানে ইন্দ্র বনাম কৃষ্ণের যুদ্ধ রয়েছে কিন্তু ভারত ও ৭৮ হাজার শ্লোক বিশিষ্ট মহাভারত হয়ে সর্বশেষ ১ লক্ষ শ্লোকের মহাভারতের যুদ্ধে ইন্দ্রপুত্র অর্জুন এবং কৃষ্ণ একই পক্ষে চলে আসছে। অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে গল্পের বিবর্তন হচ্ছে এবং চরিত্রগুলিরও প্রেক্ষিত পাল্টাচ্ছে। উপনিষদে প্রথম বিশদে দার্শনিক আলোচনা করা হচ্ছে। দর্শন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার। ফলে উপনিষদের যুগেই প্রথম প্রকৃত ‘রাজা’-র ধারণা পাওয়া যায়।

মহাকাব্যের রচনা শুরু ৮০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে। সম্ভাব্য লিখিত রূপ ৪০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দ থেকে আসতে শুরু করে।

জয়

ভারত

মহাভারত

ব্যাসদেব

ঋষি বৈশম্পায়ন

ঋষি উগ্রশ্রবা

৮,৮০০ শ্লোক

২৩,২৮২ শ্লোক

৭৮,৬৭৪ শ্লোক

ভারতের ‘জনপদ’ গ্রীক পলিস বা সিটি স্টেট-এর অনুরূপ ছিল। কিছু ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠী যারা নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক অস্তিত্ব বা নগর রাষ্ট্র তৈরি করতে পারেনি তারাই চারণ কবি হয়ে যায়। তারাই মহাকাব্যগুলির কাঠামো প্রদান করেছিল। বর্তমান মহাভারতের প্রচলিত কাহিনীর রচনা গুপ্ত যুগে সমাপ্ত হয়। আর্যদের মৌখিক বর্ণনার পদ্ধতি মহাভারতের কাহিনীতেও প্রতিফলিত হয়েছে: গল্পের মধ্যে কেউ গল্প বলছে। মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনী কেবল মহাভারতেই উল্লেখ রয়েছে কিন্তু দশ রাজার যুদ্ধের কাহিনী উল্লেখ ‘জয়’ ছাড়াও ঋগ্বেদে রয়েছে।

একটি গবেষণার মতে গ্রামীণ এলাকায় পিট্টু খেলার মধ্যে রয়েছে আর্য অধিক্রম তত্ত্বের দ্যোতনা। পিট্টু খেলাকে অনেক এলাকায় বলা হয় সাত চারা খেলা। এখানে চারা শব্দের অর্থ পোড়ামাটি, যাকে সংস্কৃতে ‘অশ্ম’ বলা হয়। অর্থাৎ সপ্তাশ্ম খেলা, যেখানে রয়েছে দাস বা দস্যু এবং পূরন্দরের ধারণা। ঋগ্বেদে বলা হয় যে ইন্দ্র অর্থাৎ পূরন্দর বা পূর ধ্বংসকারী দাস বা দস্যুদের সপ্তাশ্ম দুর্গ ধ্বংস করে যা আর্য অধিক্রম তত্ত্বের সাথে হয়তো সম্পর্কিত। তাছাড়া অনেক ঐতিহাসিকের মতে আফগানিস্তানের হেলমন্ড নদী আসলে সরস্বতী নদী এবং হরযূ > সরযূ নদীর নাম পরিবর্তিত হয়েই হেরে নামকরণ হয়েছে। যে সব গাছপালার উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে, তার সব ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায় না।

ত্রিৎসু-ভারত গোষ্ঠীর আক্রমণ থেকে পুষ্যামিত্রের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হল লুট, লুণ্ঠন ও ধ্বংস দিয়ে শুরু করে পরিশেষে আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস। ব্রাহ্মণ্যবাদ এই আধিপত্যের মতাদর্শগত ভীত। বিশ্ব যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের বিরোধীতা প্রথম ফুটে উঠেছে ‘পারস্যে’ (১৯৩২) প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে, যেখানে তিনি বলছেন, ‘বায়ুতরী যতই উপরে উঠল ততই ধরণীর সঙ্গে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যোগ সংকীর্ণ হয়ে একটা মাত্র ইন্দ্রিয়ে এসে ঠেকল, দর্শন-ইন্দ্রিয়ে, তাও ঘনিষ্ঠভাবে নয়। নানা সাক্ষ্য মিলিয়ে যে পৃথিবীকে বিচিত্র ও নিশ্চিত করে জেনেছিলুম সে ক্রমে এল ক্ষীণ হয়ে, যা ছিল তিন আয়তনের বাস্তব তা হয়ে এল দুই আয়তনের ছবি। সংহত দেশকালের বিশেষ বিশেষ কাঠামোর মধ্যেই সৃষ্টির বিশেষ বিশেষ রূপ। তার সীমানা যতই অনির্দিষ্ট হতে থাকে, সৃষ্টি  ততই চলে বিলীনতার দিকে। সেই বিলয়ের ভূমিকার মধ্যে দেখা গেল পৃথিবীকে, তার সত্তা হল অস্পষ্ট, মনের উপর তার অস্তিত্বের দাবি এল কমে। মনে হল, এমন অবস্থায় আকাশযানের থেকে মানুষ যখন শতঘ্নী বর্ষণ করতে বেরয় তখন সে নির্মমভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে; যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না, কেননা, হিসাবের অঙ্কটা অদৃশ্য হয়ে যায়। যে বাস্তবের 'পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে। গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়ো জাহাজ--অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর। বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক তত্ত্বনির্মিত উড়ো জাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে। সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য এই যে, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ [১]।

টীকা

১। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ক্ষত্রিয়দের দায়িত্ব স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে এবং গণহত্যার পক্ষে যুক্তি সাজানো হচ্ছে।  

শ্রীমদ্ভগবদগীতা ২য় অধ্যায়; সাংখ্যযোগ শ্লোক ২০:

“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্

নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে

ন, জায়তে, ম্রিয়তে, বা, কদাচিৎ,

ন, অয়ম্, ভূত্বা, ভবিতা, বা, ন, ভূয়ঃ,

অজঃ, নিত্যঃ, শাশ্বতঃ, অয়ম্, পুরাণঃ,

ন, হন্যতে, হন্যমানে, শরীরে।।“

অর্থঃ আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না৷ তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।

শ্লোক 30: 

“দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্বস্য ভারত॥ 

তস্মাৎ সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি॥

দেহী, নিত্যম্, অবধ্যঃ, অয়ম্, দেহে, সর্বস্য, ভারত,

তস্মাৎ, সর্বাণি, ভূতানি, ন, ত্বম্, শোচিতুম্, অর্হসি॥“

অর্থঃ হে ভারত! প্রাণীদের দেহে অবস্তিত আত্মা সর্বদাই অবধ্য। অতএব কোন জীবের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।

শ্লোক 31: 

“স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি । 

ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে॥

স্বধর্মম্, অপি, চ, অবেক্ষ্য, ন, বিকম্পিতুম্, অর্হসি,

ধর্ম্যাৎ, হি, যুদ্ধাৎ, শ্রিয়ঃ, অন্যৎ, ক্ষত্রিয়স্য, ন, বিদ্যতে॥“     

অর্থঃ ক্ষত্রিয়রূপে তোমার স্বধর্ম বিবেচনা করে তোমার জানা উচিত যে, ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করার থেকে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নেই। তাই, তোমার দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া উচিত নয়।

Suggested Readings

1. History of South India – Nilkanta Shastri

2. Ancient Geography – Low Price Publication

3. রামায়ণের পর্যাবরণ – Ananda Publishers

4. From Dasrajna to Kurushetra – Kanad Sinha

5. পুরাণকোষ (৩ খন্ডে) – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি

6. Religious Sects in Ancient India

7. বেদের যুগে ক্ষুধা এবং খাদ্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

8. ঋগ্বেদ – রমেশচন্দ্র দত্ত

9. Jaya – Ramchandra Jain

10. History of Ancient India – Republic vs Monarchy – Romila Thapar

11. The Aryan Debate – Thomas Trautmann

12. প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস – রণবীর চক্রবর্তী

13. Early Sanskritization Origins and Development of the Kuru State - Michael Witzel 

[পাঠচক্রের মতামত তাদের একান্ত নিজস্ব। পত্রিকা এই বিষয়ে নির্দিষ্ট অবস্থান রাখছে না। সাংস্কৃতিক কর্ষণের জন্য প্রকাশিত। ]

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

Discussion on State_Achin Vanaik

'রাষ্ট্র' সম্পর্কে আলোচনা_অচিন ভানাইক এবং কুণাল চট্টোপাধ্যায়